যেভাবে বিকশিত হচ্ছে সুকুকের আন্তর্জাতিক বাজার

বর্তমানে ইসলামী ফিন্যান্স অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত প্রডাক্টগুলোর একটি হলো ‘সুকুক’। তারল্য ব্যবস্থাপনা, বাজেট ঘাটতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপদ বিনিয়োগ ও গণ-অংশগ্রহণমূলক বিনিয়োগ হিসেবে ‘সুকুক’ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী মুসলিম ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উভয় দেশগুলোতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথম বিনিয়োগ সুকুক ইস্যু হয়। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ধাপে ‘সুকুক অকশন’ও বিপুল জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি সুকুকও ইস্যু হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই বাংলাদেশে শেয়ার মার্কেটের মতো সুকুক মার্কেটও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে।

সাম্প্রতিক ‘আইআইএফএম’ সুকুক বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চলমান প্রবন্ধে সে বিষয়েই আলোচনা করা হবে।

‘আইআইএফএম’ কী?

‘আইআইএফএম’ হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফাইন্যানশিয়াল মার্কেট’। সংস্থাটি বাহরাইনের রাজকীয় ডিক্রি ২৯-এর অধীনে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আছে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব বাহরাইন, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক ইন্দোনেশিয়া, ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়া, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব সুদান এবং ব্রুনাই দারুসসালাম সেন্ট্রাল ব্যাংক। সংস্থাটির হোস্টিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে সিবিবি (সেন্ট্রাল ব্যাংক অব বাহরাইন)। সংস্থাটির মূল কাজ ইসলামিক ফাইন্যানশিয়াল সেবা প্রদান করে এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রণয়ন করা, শরিয়াহ অনুসৃত ফাইন্যানশিয়াল চুক্তি ও প্রডাক্ট নেমপ্লেটের মানোন্নয়ন করা। শরিয়াহ অনুসৃত ফাইন্যানশিয়াল ডকুমেন্টেশন বিষয়ে মানদণ্ড প্রকাশ করা। পাশাপাশি প্রতিবছর সুকুকবিষয়ক আন্তজার্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

যা আছে প্রতিবেদনে

প্রতিবছরের মতো সম্প্রতি আইআইএফএম সুকুক বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, জুলাই-২০২১ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—

১. বেড়েছে সুকুকের ইস্যু : ২০২০ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় বিশ্বব্যাপী সুকুক (লং টার্ম ও শর্ট টার্ম) বৃদ্ধি হয়েছে ১৯.৮৬ শতাংশ (১৭৪.৬৪১ বিলিয়ন ডলার)। বার্ষিক সুকুক ইস্যুর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ।

২. সুকুক মার্কেট ক্রমবর্ধমান : ২০০১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট ১০ বছরে বিশ্ব সুকুক মার্কেটের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে সুকুক ইস্যু ক্রম-উন্নতির দিকে ধাবমান। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ব সুকুক মার্কেট ভলিউম ছিল ১৪৩.৩৫১ মিলিয়ন ডলার। সেটি ক্রমাবিকাশ হয়ে ২০২০ সালে উন্নীত হয়েছে ১৭৪.৬৪১ মিলিয়ন ডলার।

৩. সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যেসব দেশে : গত ২০২০ সালে ৫০০ মিলিয়নের অধিক, এক বছরের অধিক মেয়াদি সুকুক ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকাও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। শীর্ষ তিন ইস্যুকারী হলো, ক. মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্স সৌদি আরাবিয়া। ভলিউম : ৩৯৭২ মিলিয়ন ডলার। মেয়াদ : ৩০ বছর। আরেকটি ইস্যু করেছে ১৫ বছরের মেয়াদে। যার পরিমাণ ৬২২ মিলিয়ন ডলার। সর্বমোট : ৪৫৯৪ মিলিয়ন ডলার।

খ. গভর্নমেন্ট অব ইন্দোনেশিয়া। ভলিউম : ৩২০৬ মিলিয়ন ডলার। মেয়াদ : চার বছর। আরেকটি ইস্যু করেছে ১০ বছর মেয়াদে। এর পরিমাণ ১০০০ মিলিয়ন ডলার। সর্বমোট : ৪২০৬ মিলিয়ন ডলার।

গ. গভর্নমেন্ট অব মালয়েশিয়া। ভলিউম : ২৩৫২ মিলিয়ন ডলার। মেয়াদ : ১৯ বছর। আরেকটি ইস্যু করেছে ৩০ বছরের মেয়াদে। এর পরিমাণ ১৮০০ মিলিয়ন ডলার। সর্বমোট : ৪১৩২ মিলিয়ন ডলার।

৪. লং টার্মেই আগ্রহ বেশি : সুকুকের মেয়াদের বিবেচনায় দুটি রূপ আছে। একটি শর্ট টার্ম। এটি সাধারণত এক বছর বা এর কম মেয়াদি হয়ে থাকে। অপরটি লং টার্ম। এটি সাধারণত এক বছরের অধিক হয়ে থাকে। গত ২০২০ বছরে বিশ্বে টোটাল লং টার্ম সুকুক ইস্যু হয়েছে ১১৭.৯০৫ মিলিয়ন ডলার। অপরদিকে শর্ট টার্ম সুকুক ইস্যু হয়েছে ৫৬.৭৪১ মিলিয়ন ডলার।

৫. স্থানীয় সুকুকের পরিমাণ বেশি : সুকুকের আরেকটি দিক হলো, সুকুকের এলাকাভিত্তিক। কিছু সুকুক শুধু দেশীয় গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাইরের কেউ সেই সুকুক কিনতে পারে না। একে ‘ডোমেস্টিক সুকুক’ বলে। আর কিছু সুকুক এভাবে ইস্যু হয় যে বিশ্বের যেকোনো দেশের বাসিন্দা তা ক্রয় করতে পারে। একে ‘ইন্টারন্যাশনাল সুকুক’ বলে। ২০০১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত টোটাল ইস্যুকৃত সুকুকের মধ্যে ডোমেস্টিক সুকুকের ভলিউম ছিল ১০৯০.৫৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল গত ২০২০ বছরে। এর পরিমাণ ছিল ১৩২.২৩৩ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ওই সময়ে টোটাল ইন্টারন্যাশনাল সুকুক ভলিউম ছিল ৩৩২.৩২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল গত ২০২০ বছরে। এর পরিমাণ ছিল ৪২.৪০৮ বিলিয়ন ডলার।

৬. মুরাবাহা কাঠামো এগিয়ে : সুকুকের বহু শরিয়াহ অবকাঠামো আছে। যেমন মুরাবাহা, ইজারা, ওয়াকালাহ, মুদারাবা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে জানুয়ারি, ২০০১ থেকে ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বে যত শর্ট টার্ম সুকুক ইস্যু হয়েছে, সবটিতে মৌলিকভাবে মুরাবাহা কাঠামো-ই বেশি ছিল। তবে গত বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ছিল ইজারা সুকুক। এর পরিমাণ ছিল ৩৮ শতাংশ। মুরাবাহা ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। ২০১৯ এ ছিল সর্বোচ্চ ছিল মুরাবাহা। এর পরিমাণ ছিল ২৪ শতাংশ। তখন ইজারা ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। অর্থাৎ মুরাবাহা ও ইজারা অবকাঠামোতে বেশি অনুশীলন হচ্ছে।

বিশ্ব সুকুক মার্কেটে বাংলাদেশের অবস্থান

২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে বাংলাদেশ সরকার আট হাজার কোটি টাকার সুকুক ইস্যু করেছে। ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে সুকুকের ইস্যু একটিই। এ হিসাবে ২০২০ পর্যন্ত আলোচিত প্রতিবেদনে ওই একটি সুকুককে অবলম্বন করে জরিপ করা হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে এশিয়া ও প্রাচ্যের কিছু দেশে গত ২০০১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ডোমেস্টিক সুকুকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হার ০.০৭২ শতাংশ। হারটি কম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কেননা মাত্র একটি ইস্যুর ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। ২০২১ সালে বেক্সিমকো কম্পানি সুকুক ইস্যু করেছে। ওই জরিপে তা স্থান পায়নি। এটি যুক্ত হলে এর হার আরো বৃদ্ধি হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মালয়েশিয়া। এর হার ৬৫.৫০ শতাংশ। অপরদিকে জিসিসি দেশগুলোতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সৌদি আরব। আফ্রিকায় এগিয়ে আছে সুদান।

সুকুকের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে। এটি ভালো দিক। সুদী বন্ডের বিপরীতে ইসলামী বন্ড প্রসার হচ্ছে। তবে এসব সুকুকের শরিয়াহ পরিপালন কতটুকু হচ্ছে এমন জরিপ ও প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। এটিও হওয়া দরকার। সুকুক শুধু একটি ‘নাম’ নয়। এটি আপাদমস্তক একটি শরিয়াহ ইন্সট্রুমেন্ট। সুতরাং এতে শরিয়াহ পরিপালনের হার কতটুকু, তা জানা জরুরি। (সংক্ষেপিত)

লেখক : সিএসএএ, এ্যাওফি, বাহরাইন

Share

To get this "Shariah Tech Guideline" kindly give us your mail.

Blank Form (#12)