অনলাইনে ভাগে কুরবানী: শরীয়াহ নির্দেশনা

শুরুর কথা,

পশুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে অনেকের পক্ষেই একা গরু কুরবানি দেওয়া বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। ছাগল বা বকরী কুরবানী দেয়াও অনেকের পছন্দের তালিকায় থাকে না। আবার শহুরে জীবনে কয়েকজন মিলে ভাগে কুরবানি দেয়াও কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। পশু কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ, কুরবানির মাংস ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজ করা সহজ হয়ে উঠে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভাগে কুরবানী দেয়ার সুযোগ নিয়ে এসেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়; অন্যান্য দেশেও এ সুযোগ রয়েছে। বিষয়টি বাহ্যত ভালো। এতে সহজে কুরবানীতে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। ইবাদাত আদায়ের সহজ পদ্ধতি গ্রহণে ইসলামে বাধা-নিষেধ নেই। তবে সেই সহজ পদ্ধতি অবশ্যই শরীয়াহ-সম্মত হতে হবে।

আমাদের দেশে অনলাইনে ভাগে কুরবানী দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে,অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাতে নানা শরীয়াহ্ অস্পষ্টতা, ঝুঁকি রয়েছে নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে এগুলো পরিচালিত নয় (আমাদের জানামতে) ফলে যারা নিরাপদ পদ্ধতিতে কুরবানীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত আদায়ের ইচ্ছা করেন, তাদের জন্য এটি নিরাপদ নয়

কেন নিরাপদ নয়, সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করাই বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। সুনির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠানকে খাঁটো করা উদ্দেশ্য নয়। বরং তারা যেন শরীয়াহসম্মত পন্থায় সঠিকভাবে এ সেবা প্রদান করতে সক্ষম হন,তাদেরকে সে সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য। তাই এতে একটি শরি’আহ্ অবকাঠামোও নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু এ আলোচনা উপকারী করে দিন। আমীন-

কুরবানী: একটি ইবাদত

কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশেষ ইবাদত। এটা আদম আ.-এর যুগ থেকে বিদ্যমান ছিল। সূরা মায়েদায় (আয়াত ২৭-৩১) আদম আ.-এর দু’সন্তানের কুরবানীর কথা এসেছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে কুরবানীর পন্থা এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে কুরবানীর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’তে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। এজন্য কুরবানীকে ‘সুন্নতে ইবরাহীমী’ নামেও অভিহিত করা হয়।

তাছাড়া এটি ‘শাআইরে ইসলাম’ তথা ইসলামের প্রতীক হিসেবে পরিচিত বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর মাধ্যমে শাআইরে ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর গুরুত্ব বিষয়ে নিম্নোক্ত সহীহ হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-হযরত জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من ذبح قبل أن يصلي فليعد مكانها أخرى، ومن لم يذبح فليذبح.

‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করল, সে যেনো ঐ পশুরু স্থানে আরেকটি পশু কুরবানী করে। আর যে কুরবানী করেনি, সে যেনো কুরবানী করে নেয়’-সহীহ বুখারী, ৫৫৬২

হযরত আবু হুরাইরা রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

من كان له سعة ولم يضح فلا يقربن مصلانا

‘যার সামর্থ্য আছে, অথচ সে কুরবানী করলনা, সে যেনো আমাদের ঈদগাহে না আসে’-সুনানে ইবনে মাজাহ, ৩১২৩ (قال ابن حجر رح.في فتح الباري 10/5: رجاله ثقات، اهـ.، و صحح الحاكم إسناده في المستدرك-7564، ووافقه الذهبي، اهـ.، قال ابن عبد البر في التمهيد 10/80: الأغلب عندي في هذا الحديث أنه موقوف على أبي هريرة والله أعلم اهـ.))

উপরোক্ত হাদীস ও বর্ণনার আলোকে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানীর আমলের গুরুত্ব স্পষ্ট। ইসলামী ফিকহে-সকল মাযহাবের ফকীহগণের কাছে কুরবানীর আমল একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হিসাবে বিবেচিত। এ ব্যাপারে কারও কোনও দ্বিমত নেই। কোনও মাযহাবে এ আমলকে হালকাভাবে দেখা হয়নি।

তবে এর গুরুত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে ফকীহগণ পরিভাষাগত কিছু মতভেদ করেছেন। শাফেয়ী, হাম্বলী ফিকহে এক্ষেত্রে ‘সুন্নতে মুআক্কাদা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (শরহুল মুহাযযাব ৮/৩৮৩, মুগনী, ১১/৯৫)

মালেকী ফিকহে-‘সুন্নতে ওয়াজিব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি তাঁরা বলেছেন, কোনও এলাকার সকল সামর্থ্যবান মুসলিম যদি কুরবানী পরিত্যাগ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। (লাওয়ামিউদ দুরার শরহে মুখতাসারি খলীল, ৫/১০৪)

হানাফি ফিকহে-সরাসরি ‘ওয়াজিব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে । (কিতাবুল আছল, ৫/৪১৩)

মোটকথা-কুরবানীর গুরুত্ব নিয়ে কারও মাঝে দ্বিমত নেই। কেবল গুরুত্ব প্রকাশের উপস্থাপনে দ্বিমত হয়েছে। তবে পূর্বোক্ত হাদীস ও বর্ণনার আলোকে আমাদের কাছে কুরবানীর গুরুত্ব প্রকাশে ‘ওয়াজিব’ শব্দ অধিক অগ্রগণ্য।

ইবনে তাইমিয়া রহ. স্পষ্ট বলেছেন-

أما الأضحية فالأظهر وجوبها، فإنها من أعظم شعائر الإسلام.

‘কুরবানীর ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগণ্য বক্তব্য হল-এটি ওয়াজিব। কারণ তা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনসমূহের একটি।’ (মাজমুআতুল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, ১২/৯৭)

ইবাদতের মূলকথা

ইবাদতের মূলকথা হল-আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। যথা-ক. ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা। খ. শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা। সুতরাং কুরবানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত আদায়ে উক্ত বিষয়টি লক্ষ্য রাখা জরুরী।

কুরবানী: স্রেফ রুসম-রেওয়াজ নয়

কুরবানী-একটি ওয়াজিব ইবাদত। এটি স্রেফ কোনও রুসম-রেওয়াজ নয়। আমোদ-প্রমোদ করা কিংবা গোশত ভক্ষণ-ই এর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে দেখা যায়, বেশ আনন্দ-উল্লাসের সাথে কুরবানী আদায় করা হয়। এটি যে একটি ইবাদত-এ ধারণা অনেকের মাঝেই প্রবল থাকে না। ফলে আমোদ-প্রমোদ-ই প্রবল হয়ে উঠে। শরিআহসম্মত উপায়ে ইখলাসের সাথে ইবাদত পালনের মানসিকতা গড়ে উঠে না। বছরের অন্যান্য সময় যেমন গোশত খাওয়া হয়; কুরবানীও যেন সেরকম গোশত ভক্ষণের মোক্ষম উপলক্ষ!! আমাদের এ চিন্তার সংশোধন জরুরী।

কুরবানী: ব্যবসার মৌসুম নয়

কুরবানী-শুরু থেকে শেষ-পুরোটা একটি ইবাদত। এখানে গোশত ভক্ষণ-ই মূল নয়। সুতরাং একে কেন্দ্র করে ব্যবসা ও অতি মুনাফা কামানোর চিন্তা সঠিক নয়। ব্যাপারী, ব্যবসায়ীদের একে কেন্দ্র করে পশুর উচ্চ মূল্য ধার্য্য করা। নানা উপায়ে একে বাণিজ্যকরণ করা- কুরবানীর মূল বার্তার সাথে মানানসই নয়। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে কুরবানী কেন্দ্রিক যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে, তাতে সেবার মানসিকতার তুলনায় বাণিজ্যিক মানসিকতাই প্রবল। বরং অসৎ উপায়ে পশু মোটা-তাজা করার ন্যাক্কারজনক কাজও করা হয়ে থাকে। ব্যবসায়ী, ব্যাপারী ভাইদের উচিত, সঠিক নিয়তে, মানুষকে ইবাদত পালনে সহযোগিতার নিয়তে ব্যবসা করা। আর ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা। এতে ব্যবসাও হবে, সওয়াবও হবে।

ভাগে কুরবানীর বৈধতা

ভাগে কুরবানী দেয়া নিঃসন্দেহে বৈধ। সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي سَفَرٍ فَحَضَرَ الأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِي الْبَقَرَةِ سَبْعَةً

“এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। এরকম পরিস্থিতিতে কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হল। তখন আমরা একটি গরুতে সাতজন অংশীদার হয়ে কুরবানী আদায় করলাম।”-জামে তিরমিযী, ১৫০১ (قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ ابْنِ عَبَّاسٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ)

প্রচলিত অনলাইন ভাগে কুরবানী ও শরীয়াহ অস্পষ্টতা/ঝুঁকি

অর্থের উৎস হালাল হওয়া

ভাগে কুরবানীর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কুরবানীতে সকল শরীক বা অংশীদারদের প্রদেয় অর্থ হালাল উৎস থেকে হওয়া। হারাম আয় থেকে না হওয়া। আমরা আগেই জেনেছি-কুরবানী একটি খালেস আর্থিক ইবাদত। আর প্রতিটি আর্থিক ইবাদত হালাল উৎস থেকে হওয়া একান্ত জরুরী। অন্যথায় তা কবুল হবে না। সুতরাং ভাগে যে কুরবানি দিবে, তার নিজের প্রদেয় অংশ যেমন হালাল থেকে হতে হবে, তেমনি অন্যান্য শরিকদের প্রদেয় অংশটুকুও হালাল থেকে হতে হবে। কারও প্রদত্ত অংশ হারাম থেকে হলে, অন্যদের জন্য সেই পশুতে শরীক হওয়া জায়েয নয়। যেমন, সুদী কারও সাথে কুরবানীতে অংশগ্রহণ করা। (কিফায়াতুল মুফতি, ১২/৯৬)

সুতরাং ভাগে কুরবানী দেয়ার ক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে জানা যায়, বুঝা যায়-তার আয় হালাল, কেবল এমন লোকের সাথেই অংশগ্রহণ করা যাবে। তবে অন লাইনে যেহেতু বিষয়টি উন্মুক্ত থাকে, তাই সেখানে ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণের ফর্মে ‘হালাল আয় থেকে অংশগ্রহণ করা হয়েছে’ বিষয়টি স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। পাশাপাশি আয়ের প্রধান উৎসও উল্লেখ করতে হবে। এতে অন্যদের জন্য শরিক হওয়া সহজ হবে[1]

প্রচলিত অনলাইন ভাগে কুরবানীর পদ্ধতিতে কে কোন উৎস থেকে অর্থ প্রদান করে ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণ করছে- তা জানার সুযোগ নেই। অর্থের উৎস ডিসক্লোজ করার কোনও অপশন এসব সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে নেই। সুতরাং এটি স্পষ্ট না হয়ে কারও জন্য এমন অস্পষ্ট অন লাইন ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণ শরিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

কুরবানীর নিয়ত

কুরবানী মূলত একটি খালেস ইবাদাহ। তাই এখানে পরিচ্ছন্ন ও সঠিক নিয়ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত পরিশুদ্ধ হওয়ার অর্থ হল, এমন কোনও নিয়ত করা যাবে না, যা অন্যান্য শরীকদের কুরবানী সঠিক হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক। যেমন, কেউ পেছনের কোনও বছরের কাযা বা অনাদায়ী কুরবানীর নিয়ত করে বসল। এমনটি হলে পুরো গোশত সাদাকা করে দিতে হবে। আবার এমন কোনও নিয়তও করা যাবে না, যার কারণে ব্যক্তির কুবরানী-ই সঠিক হয় না। যেমন, কেউ ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণ করেছে। তার উদ্দেশ্য বা নিয়ত-কুরবানী নয়। অথবা কোনও ইবাদত আদায়ের ইচ্ছা বা নিয়ত নেই। কেবল গোশতের ভাগ নেওয়ার জন্য শরীক হয়, তাহলে সে পশুতে যারা কুরবানীর উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করেছে । এমনটি হলে তার নিজের কুরবানীও হবে না, অন্যান্য শরীকদেরও কুরবানী হবে না। সুতরাং ভাগে কুরবানীতে নিয়তের পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রচলিত অনলাইন ভাগে কুরবানীতে এমন সূক্ষ্ম বিষয় যাচাই করার কোনও পদ্ধতি নেই। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে অনলাইন ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণ করা শরীয়াহ-দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।[2]

এক্ষেত্রে করণীয় হল, যারাই ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণের জন্য ইচ্ছা করবে, তাদেরকে প্রথমেই একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। অনলাইনে এই ফর্ম থাকবে। এতে নিয়তের পরিশুদ্ধতার ঘোষণা থাকবে। পাশাপাশি-কুরবানীর তাৎপর্য, কুরবানী সঠিক হওয়ার মৌলিক নির্দেশনা ইত্যাদি শরীয়াহ-নীতিমালা বিষয়ক একটি সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকাও ওয়েবসাইটে থাকবে। অংশীদারে আগ্রহীরা সেটি পড়ে নিবে। এতে ভাগে কুরবানী সকলের জন্য নিরাপদ সাব্যস্ত হবে।

ভাগের টাকা প্রদান

অনলাইনে যারা ভাগে ‍কুরবানীর প্রস্তাব করেন, তাদের দুটি অবস্থা হয়ে থাকে। যথা-

১। পশু আগে থেকে তাদের সংগ্রহে নেই। ভাগের টাকা নিয়ে পশু ক্রয় করা হবে। এরপর কুরবানী করা হবে। এ সূরতে ভাগে টাকা দেয়ার অর্থ হলো অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে পশু ক্রয়ে ওকীল নিযুক্ত করা। সুতরাং এক্ষেত্রে পশু ক্রয়ের পর টাকা থেকে গেলে তা ফেরৎ দিতে হবে। আর পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে চাইলে আলাদা করে নির্ধারণ করতে হবে।

২। পশু আগে থেকে তাদের সংগ্রহে আছে। সেক্ষেত্রে ভাগে টাকা দেয়ার অর্থ প্রথমে তাদের থেকে পশু ক্রয় করা। আর যেকোনও ক্রয় চূড়ান্ত হয় তা ‘কবয’ (হস্তগত) করার মাধ্যমে। এখানে সেটি হয় না। ভাগে কুরবানী সার্ভিসদাতা (বিক্রেতা)-কেই ক্রেতার পক্ষে পশু হস্তগত করার উকীল নিযুক্ত করাও শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভব নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যূ। অনলাইনে যারা এ সেবা দিয়ে থাকেন, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়-পশু তারা আগে থেকেই ক্রয় করে রাখেন। এরপর ভাগ গ্রহণের আহবান করেন।

এভাবে কুরবানী করা হলে তা সঠিক হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। বিষয়টি নানাভাবে সমাধান করা যায়-

ক. কসাই বা কোম্পানির এম্প্লয়ী নয়-এমন কাউকে ক্রেতাদের পক্ষে পশুটি হস্তগত করার জন্য উকীল নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা। এক্ষেত্রে পশুটি বিক্রেতার কাছে আমানত হিসাবে থাকবে।

খ. কোম্পানি কর্তৃক পার্শ্ববর্তী মসজিদের ইমাম সাহেবকে ক্রেতাদের পক্ষে হস্তগত করার উকীল হিসাবে উপস্থাপন করা।

(এখানে আরও কিছু সমাধান আছে, যা কেবল উচ্চতর ফিকহ বোর্ডে আলোচনা করা যেতে পারে। সেগুলো আরও অধিক সহজ সমাধান)

প্রাসঙ্গিক নানা শরীয়াহ ঝুঁকি

প্রচলিত অনলাইন ভাগে কুরবানীতে অংশগ্রহণে আরও নানা ধরনের শরীয়াহ ঝুঁকি রয়েছে। সংক্ষেপে তা হল-

-কোরবানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো, কুরবানীর পশুর কোনও অংশ বিক্রয়যোগ্য নয়। অনলাইনে যারা এ ধরনের ব্যবসা করেন, তারা পশুর থেকে যাওয়া নানা অংশ কী করেন, কোথায় ব্যবহার করেন- এগুলো স্পষ্ট নয়।

-চামড়া কোথায় ব্যয় করা হয়? এর বিক্রয়লবদ্ধ টাকা কী করা হয়, তা স্পষ্ট নয়।

-পশু যবাইয়ের পর গোশত সঠিকভাবে মেপে ৭ ভাগ করা-এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাপায় কম-বেশি হতে পারবে না। তদ্রূপ আগে থেকে প্রত্যেক শরিকের জন্য ওযন নির্ধারিত করে রাখা। এরপর পূর্ব নির্ধারিত ওযনে গোশত প্রদান করাও সঠিক পদ্ধতি নয়। কারণ একেক পশুর ওযন একেক রকম হয়। এতে দেখা যাবে, ওযন ঠিক রাখতে গিয়ে অন্য পশুর গোশত দেয়া হয়েছে। তখন এক পশুতে ৭ এর অধিক অংশগ্রহণ হয়ে যাবে। এতে কারও কুরবানী হবে না। আবার ঘোষিত ওযনের চেয়ে গোশত অধিক হলে, সেটিও অনুমোদন ছাড়া রেখে দেয়া যাবে না।

-ঈদের চুতুর্থ দিনও গোশত সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুরবানী কবে হবে, তা উল্লেখ করা নেই।

-অংশীদার কারা হতে পারবে, এর কোনও সুনির্দিষ্ট শরীয়াহ নির্দেশনা নেই। এমনও হতে পারে, অমুসলিম কেউ ভাগে অংশগ্রহণ করে বসল। এমনটি হলে কারও কুরবানী হবে না।  এগুলো যাচাই করা, শরীকগণের এসব বিষয়ে নিশ্চিত থাকার সুযোগ দৃশ্যমাণ নয়।

-বিদেশ থেকে কেউ ভাগে অংশগ্রহণ করলে, সেই গরু এমন দিনে কুরবানী করতে হবে, যখন উভয় দেশে কুরবানির দিন চলমান থাকে। অন্যথায় বিদেশের লোকের পক্ষে কুরবানী হবে না। এ বিষয়টিও স্বচ্ছ নয়।

-কখনও দেখা যায়, ভাগে কুরবানী সার্ভিস প্রদানকারীদের কাছে আগে থেকে পশু থাকে না, সেক্ষেত্রে তারা শরিকদের টাকায় পশু ক্রয় করেন। এরপর তাদের পক্ষে কুরবানী করেন। এখানে মূল লেনদেনটি হচ্ছে-ওয়াকালাহ। সুতরাং কোনও টাকা বেঁচে গেলে সেটি ফেরৎ দিতে হবে বা রেখে দিতে চাইলে অনুমোদন নিতে হবে। অথবা আলাদা করে স্পষ্টভাষায় ওয়াকালাহ সার্ভিস চার্জ হিসাবেও পূর্ব থেকে চুক্তি হতে পারে। সুতরাং এগুলো কোনও একটি না করে সরাসরি অতিরিক্ত টাকা রেখে দেয়া যাবে না।

-কখনও দেখা যায়, আগে থেকে পশু থাকে। সেক্ষেত্রে পশুর মূল্য ও প্রাসঙ্গিক খরচের টাকা-আলাদা করে নির্ধারণ করতে হবে। কারণ তখন দুটি লেনদেন হয়। এক. তাদের থেকে পশু ক্রয় করা। দুই. পশু কুরবানী ও প্রাসঙ্গিক কাজ আঞ্জাম দেয়া। এটি ওয়াকালাহ চুক্তি। এ বিষয়টি বেশ অবহেলিত। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, তারা পশু ক্রয় করে কুরবানী করবে। অথচ পশু আগে থেকেও তাদের কাছে থাকতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। (মাসিক আল বালাগ, ১৪৪৩ হি. যিলহজ্জ সংখ্যা, পৃ. ৩৭ https://www.facebook.com/photo?fbid=655207136621220&set=pcb.655207973287803 )

মোটকথা, এ ধরনের আরও নানা জটিল ও সূক্ষ্ম শরিআহ ইস্যূ আছে, যা নিরসনের জন্য স্বতন্ত্র শরিআহ বোর্ডের বিকল্প নেই।

অনলাইন ভাগে কুরবানীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য পরামর্শ

আগেও বলেছি-কুরবানীর এ সেবাটি একটি মহৎ কর্ম। অনেকের জন্যই কুরবানীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করা এর মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠে। তবে তা যেহেতু একটি ইবাদত, তাই এ সেবা সঠিকভাবে প্রদানের জন্য তাদের করণীয় হল-

১। নিয়ত পরিশুদ্ধ করা। মানুষকে ইবাদত আদায়ে সহায়তা করার নিয়ত রাখা। এতে অর্থ আসা বন্ধ হবে না।

২। নির্ভরযোগ্য মুফতিয়ানে কেরাম এর মাধ্যমে একটি শরীয়াহ বোর্ড বা কমিটি গঠন করা। তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কার্যক্রম শরীয়াহর আলোকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।

৩। সুনির্দিষ্ট একটি শরীয়াহ অপারেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা। এরপর সে অনুযায়ী পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা। এই ফ্রেমওয়ার্কে মোটা দাগের তিনটি বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। যথা-ক. অর্থ প্রদান সংক্রান্ত নির্দেশনা। খ. অংশগ্রহণকারীদের যোগ্যতা বিষয়ক নির্দেশনা। গ. জবাই, গোশত বণ্টন সংক্রান্ত নির্দেশনা। পাশাপাশি গ্রাহকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কুরবানী বিষয়ক শরীয়াহ নির্দেশনা সংক্রান্ত লেখা ওয়েবসাইটে শেয়ার করা।

৪। অনলাইন ফর্ম রাখা। যারাই আগ্রহী হবে, তাদেরকে সেই ফর্ম পূরণ করতে হবে। সেটি প্রত্যেক অংশীদারের সাথে শেয়ার করা হবে। সেই ফর্মে নাম, ঠিকানা ইত্যাদি থাকার পাশাপাশি মৌলিকভাবে যা থাকবে- বয়স, ধর্ম, পেশা, অর্থের উৎস, নিয়ত, চামড়ার ব্যাপারে অনুমোদন, পশুর অতিরিক্ত অংশ থেকে গেলে তার ব্যাপারে অনুমোদন।

শেষ কথা, কুরবানী একটি ইবাদত। এটি কোন ‘মাংসভোজ’ নয়। এতে যদি কষ্ট হয়, তাহলে তা হবে কেবল আল্লাহর জন্য। বরং একটি ইবাদাত যথাযথভাবে, সুন্নাহসম্মত পন্থায় পালন করতে গিয়ে কষ্ট হলে, তা তো বান্দা হিসাবে আমার সৌভাগ্যের বিষয়। সুতরাং শুধু সামান্য কষ্ট লাঘবের জন্য এতো এতো ঝুঁকি যেখানে আছে-এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা বিবেকবান কোনও মুসলিমের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সুতরাং হয় নিজেদের পরিচিত মুসলিমদের সাথে গরু কুরবানী করুন। যেখানে উপরোক্ত ঝুঁকিসমূহ থাকবে না। আর না হয়, ছাগল বা বকরী দিয়ে কুরবানী করুন। যাদের সামর্থ্য কম তাদের জন্য এটি সবচেয়ে ভালো সমাধান।

তবে যারা এসব সেবা দিতে আগ্রহী, তারা এ সেবাকে শরীয়াহসম্মত উপায়ে প্রদান করতে হলে পূর্বোক্ত নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করবো, যারা এ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তারা উক্ত নির্দেশনা অণুসরণ করে এ সেবাকে আরও অধিক মুসলিমবান্ধব করবেন। এতে বহু মানুষের জন্য সহজে ইবাদত পালনের সুযোগ তৈরি হবে। নিয়ত বিশুদ্ধ করে নেয়া হলে ব্যবসার পাশাপাশি এটিও হয়ে উঠবে সওয়াবের কারণ।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রতিটি ইবাদাত সুন্নাহসম্মত উপায়ে করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

যিলহজ্ব, ১৪৪৫হি./২৫ জুন, ২০২৩ ইং


[1] শরিক কুরবানীতে কারও আয় হারাম থেকে হলে, বাকি সকলের কুরবানী  কি সহীহ হবে না?  কারও মতে এক্ষেত্রে কারও কুরবানী সহীহ হবে না। যেমন, শরিকদের কেউ অমুসলিম হলে কারও কুরবানী সহীহ হয় না।  তদ্রূপ কেউ স্রেফ গোশত খাওয়ার নিয়ত করলে কারও কুরবানী সহীহ হয় না। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৭/৫০৩) তবে দারুল উলূম দেওবন্দের সম্প্রতি ফতোয়া অনুসারে ‘কারও কুরবানী সহীহ হবে না’ কথাটি সমর্থনযোগ্য নয়। হাঁ, তার নিজের কুরবানী কবুল হবে না-সেটি ভিন্ন কথা। (https://darulifta-deoband.com/home/ur/qurbani-slaughtering/176257 ) মূলত হারাম সম্পদ দিয়ে কুরবানী করার মূল বিধান-ক. এমনটি করা বৈধ নয়। খ. এমনটি করা হলে তা কবুল হবে না। গ. কেউ করে ফেললে তা দুনিয়ার বিচারে আদায় হয়ে গেছে বলে বিবেচিত হবে। ফকীহগণের ভাষায়-‘ফরয বা দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে’। আমাদের কাছে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া-ই অগ্রগণ্য। আকাবির থেকে মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ. এ প্রসঙ্গে ‘অন্যদের কারও কুরবানী সহীহ হবে না’ এমন কথা বলেননি। (কিফায়াতুল মুফতি, ১২/৯৬) তাছাড়া কেউ যদি চুরি করে ছাগল কুরবানী করে, তাহলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হলে সেই কুরবানীও সহীহ হয়ে যায়। এখন কেউ যদি ব্যাংকের সুদের টাকায় কুরবানীতে শরিক হয়, এরপর সেই পরিমাণ টাকা দান করে দেয়, তাহলে তার কুরবানীও আদায় হয়ে যাবে। এই আদায় সওয়াবযোগ্য হবে। আর সুদের টাকা দান না করা হলে-সওয়াববিহীন আদায় হবে। তদ্রূপ কেউ যদি কোনও জমি গসব করে, তাতে নামায পড়ে, তাহলে এতে নামায হয়ে যায়। যদিও গসব স্বতন্ত্র গুনাহ। নামাযের সওয়াব হবে না। তবে ফরয আদায় হয়ে যাবে। মোটকথা, এসব দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট, কোনও শরিকের আয় হারাম হলেও অন্যদের কুরবানীও সহীহ হবে না-কথাটি অগ্রগণ্য নয়। তবে এমন লোকের সাথে কুরবানীতে শরিক হওয়াও বৈধ নয়।

[2] প্রকাশ থাকে যে, ভাগে কুরবানী বা কুরবানীতে তিন ধরনের নিয়ত হতে পারে। যথা-১. কোনো ব্যক্তি কুরবানী আদায়ের জন্য পশু ক্রয় করেছে অথবা কোনো পশুতে অন্যদের সাথে অংশ নিয়েছে। তার মনে এ নিয়ত আছে যে, কুরবানী সম্পন্ন হওয়ার পর গোশত খাবে। যেমনটি প্রায় সকল কুরবানীদাতার মনে নিয়ত থাকে। এভাবে নিয়ত থাকা সঠিক। বরং কুরবানীর গোশত খাওয়া একটি মুস্তাহাব আমল। ২. এক ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। সে এ নিয়তে কুরবানীর পশু ক্রয় করল যে, ঈদের দিন তো নিজের এবং পরিবারের লোকদের খাওয়ার জন্য গোশতের দরকার। সে চিন্তা করে দেখল, বাজার থেকে গোশত তো কিনতে হয়। তাই গোশত না কিনে পশুতে অংশ নিই। তাহলে একদিকে নফল কুরবানীও আদায় হবে এবং সওয়াবও লাভ হবে। অপরদিকে খাওয়ার জন্য গোশতও পাওয়া যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে পশু ক্রয় করল বা পশুতে অংশ রাখল। এভাবে নিয়ত করলেও ভুল হবে না। কুরবানির নিয়ত থাকায় কুরবানী হয়ে যাবে। যদিও অন্য নিয়তও ‍উপলক্ষ হিসাবে কাজ করায় সওয়াব হয়তো কম পাবে। ৩. ওয়াজিব, নফল কোনো ধরনের কুরবানীর একদম নিয়তই নেই; বরং শুধু গোশতের জন্য ভাগ রাখল। যেমন বছরের অন্য সময় কয়েকজন মিলে গোশতের জন্য গরু যবাই করে থাকে। এ ধরনের নিয়ত মূলত আপত্তি। এ নিয়ত করলে কারও কুরবানী হবে না। এটিই এখানে আলোচনা করা উদ্দেশ্য। (মাসিক আল কাউসার, জুন, ২০২৩)

লেখকঃ মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম হাফিজাহুল্লাহ,

সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা,

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি, সিএসএএ, অ্যাওফি বাহরাইন।

Share