(হালাল/ সুদমুক্ত/ শরীয়াহসম্মত ব্যবসায় বিনিয়োগকারী/ বিনিয়োগে আগ্রহী যে কেউ অবশ্যই পড়বেন, অন্যদেরও আশা করি কাজে আসবে।)
গত পরশু একটি খবরে চোখ পড়ল। সুদমুক্ত শরীয়াহ সম্মত ব্যবসার নামে জনৈক ব্যক্তি কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই খুব সংক্ষেপে।
১. ব্যবসা মৌলিকভাবে একটি হালাল কাজ, সৎ ব্যবসায়ীকে কিয়ামতের দিন বিশেষভাব সম্মানিত করার কথা হাদীসে এসেছে (তিরমিযী: ১২০৯)। রিবা (সুদ) হারাম ঘোষণার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় তথা ব্যবসাকে হালাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন (আল-কুরআন, ২:২৭৫)। কাজেই রিবা থেকে সত্যিই বাঁচতে চাইলে নিজে বা অন্যের সঙ্গে বিনিয়োগ/শেয়ারে ব্যবসার কোনো বিকল্প নেই।
২. প্রতিটি ব্যবসা ঝুঁকিযুক্ত। ঝুঁকি গ্রহণই মূলত লাভের অধিকার দেয়। ঝুঁকি সম্পূর্ণ বাদ দেয়া যায় না, তবে কমানো যায়। বিনিয়োগ বা ব্যবসা থেকে ঝুঁকিকে পুরোপুরি বাদ দিলে সেটা রিবায় পরিণত হয়। কোন ব্যবসায় হয়তো ঝুঁকি কম হতে পারে বা বেশি হতে পারে। ব্যবসার পরিচালকের দক্ষতার স্বাক্ষর হবে ব্যবসায় ঝুঁকিকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা।
৩. হালালভাবে ব্যবসার জন্য দুটো গুণ সমানভাবে প্রয়োজন, বরং যেকোনো দায়িত্বের জন্যই এ গুণ দুটো অপরিহার্য। ক্বুওয়াহ – শারীরিক, মানসিক ও জ্ঞানগতভাবে ব্যবসায়িক কার্যসম্পাদনে সক্ষম হওয়া, হালাল-হারামের জ্ঞান থাকা; এবং আমানাহ – প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি, সম্পদ ও যাবতীয় দায়িত্বের প্রতি বিশ্বস্ততার স্বাক্ষর দেয়া।
মূসা আ. যখন মাদয়ানে যান, শুয়াইব আ. এঁর এক কন্যা তাঁর বাবার কাছে প্রস্তাব রাখেন যেন মূসাকে আ. কাজে রাখা হয়, কারণ তিনি ক্বাউয়ী এবং আমীন (সূরা কাসাস: ২৬)। ওদিকে ইউসুফ আ. নিজেকে খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রাখার আবেদনে নিজের যোগ্যতা হিসেবে তুলে ধরেন যে তিনি হাফীয ও আলীম (সূরা ইউসুফ: ৫৫)। হাফীয ও আলীম তথা সংরক্ষণকারী ও জ্ঞানী, এ দুটো পূর্বোক্ত দুটো গুণের ভেতরই আছে। (এ ব্যাপারে আমার বিস্তারিত নোট পড়ুন: https://tinyurl.com/quwwah-amanah)
৪. শুধু ক্বুওয়াহ থাকলে হয়ত ব্যবসা ভাল হবে, তবে তার বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করতে পারেন। আবার শুধু আমানতদার হলে তিনি সবার সাথে সত্য বলবেন বটে, তবে ব্যবসার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকায় বড় রকম ক্ষতি হতে পারে। কাজেই ব্যবসার অভিজ্ঞতা-যোগ্যতা এবং একইসঙ্গে আমানতদারীতা ও সততা – দুটোই সমানভাবে অপরিহার্য।
৫. মুয়ামালা বা লেনদেনের ক্ষেত্রে সবাইকে অপরিচিতের ন্যায় মনে করতে হবে। এখানে আবেগের আসলে খুব জায়গা নেই। আবেগ আসবে আচরণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে, মানুষের সাথে আমাদের ব্যবহার হবে নিজ আত্মীয়র মত। কাজেই, প্রতিটি লেনদেনের আগে সে সম্পর্কে জানা যাচাই-বাছাই করা – এগুলো খুব মৌলিক ব্যাপার। একজন খুব সুন্দর বক্তব্য দিয়ে বা ভালো পরিচয় নিয়ে কোন লেনদেনে আহ্বান জানালো, আর আমি যাচাই বাছাই না করেই জড়িয়ে গেলাম – এটা একজন সজাগ মুমিনের গুণ নয়।
একজন মুমিন শুধু বিশ্বাসেই শক্তিশালী হবেন এমনটি নয়, লেনদেনে বাছবিচারের ক্ষেত্রেও তিনি সজাগ হবেন। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন একজন মুমিন একই গর্তে দুবার দংশিত হয় না (বুখারী: ৬১৩৩)।
৬. একজন মুসলিমকে ব্যবসা অবশ্যই হালালভাবে, শরীয়তসম্মতভাবে করতে হবে। তবে শরীয়তসম্মত হলেই সে ব্যবসা লাভজনক হবে – এমনটা জরুরি নয়। আবার শরীয়তসম্মত না হলেই সে ব্যবসা অলাভজনক হবে – বিষয়টা সে রকমও নয়। কাজেই লাভজনক ব্যবসা শুনেই যেমন আমরা এটাকে হালাল ধরে নেব না, একইভাবে হালাল বা শরীয়ত সম্মত শুনেই আমরা সেটা লাভজনক ব্যবসা বলে মনে করব না।
৭. ব্যবসা শরীয়ত সম্মতভাবে হওয়ার জন্য কিছু গভর্নেন্স বা সুশাসন নীতি রয়েছে, আমরা যাকে শরীয়াহ গভর্নেন্স বলে জানি। শরীয়াহ গভর্নেন্সের একটি মৌলিক শর্ত হল ব্যবসার শরীয়াহ নিশ্চিত করার জন্য শরীয়াহ বোর্ড থাকা। শরীয়াহ বোর্ড অভ্যন্তরীন হতে পারে, কিংবা প্রতিষ্ঠান যদি ছোট হয় সেক্ষেত্রে বাহিরের কোন শরীয়াহ পরামর্শক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে পারে।
শরীয়াহ বোর্ড যোগ্য ও স্বাধীন হবে, নির্মোহভাবে মতামত প্রকাশ করবে। শরীয়াহ বোর্ড প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হবেন না, কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় কোনোরূপ অংশ নেবেন না। শরীয়াহ বোর্ড এর দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠান শরীয়াহ পরিপালনে কোন পর্যায়ে আছে তা শেয়ারহোল্ডারদের জানানো, শরীয়াহর আলোকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়া। তবে শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করা কিংবা শরীয়াহ বোর্ড এর বক্তব্য বাস্তবায়ন করা – এটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদ, ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ড অফ ডাইরেক্টর এর দায়িত্ব।
৮. প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিষদ, ম্যানেজমেন্ট এর বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গ প্রতিষ্ঠান সুন্দরভাবে পরিচালনা করছেন কিনা – সে জন্য রয়েছে কর্পোরেট গভর্নেন্স বা কর্পোরেট শাসন নীতি। এ নীতিমালার আলোকে ব্যবস্থাপনা পরিষদ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে আর কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমতির প্রয়োজন হবে, কিংবা বোর্ডের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে, এই বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।
শেয়ারহোল্ডারদেরকে নিয়মিত রিপোর্ট দেয়া, ব্যবসার বাস্তব পরিস্থিতি জানানো, বছর শেষ হলেই একাউন্টসকে অডিট-এর জন্য সাবমিট করা – এসব বিষয় ভালো কর্পোরেট গভর্নেন্স এর উদাহরণ। একটি হালাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে শক্তিশালী কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং শরীয়াহ গভর্নেন্স মেনে চলবে।
৯. কোথাও বিনিয়োগ করার আগে প্রতিষ্ঠানের বিগত কয়েক বছরের আর্থিক বিবরণী দেখুন, তাদের বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের সাথে তাদের কার্যাবলী কেমন তা দেখুন, ব্যবসাটি সম্পর্কে একটি স্বাভাবিক ধারণা নিন। চুক্তি ভালভাবে পড়ুন এবং সবসময় লিখিত চুক্তি করুন। চুক্তির প্রতিটি ধারা, বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান কোন অবহেলা বা প্রতারণা করলে সে ক্ষেত্রে কিভাবে সুরাহা করা হবে – এই বিষয় গুলো পরিষ্কার করে নিন। চুক্তি লিখিত হওয়ার ছাড়া কোন বিনিয়োগ কখনো করবেন না।
প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখুন। তাদের অতীতে সফল ও ব্যর্থ ব্যবসাগুলো কী, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা আছে কিনা, আমানাহ আছে কিনা এ বিষয়গুলো দেখুন। সর্বোপরি যে ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন এ ব্যবসায় ন্যূনতম কিছু ধারণা গ্রহণ করার চেষ্টা করুন। যেহেতু ঝুঁকিমুক্ত কোনো ব্যবসা নেই কাজেই যতটুকু ঝুঁকি গ্রহণ করা সম্ভব ততটুকুই বিনিয়োগ করুন। একই জায়গায় নিজের সব পুঁজি দিবেননা, ব্যক্তি যেই হোক না কেন। এক কথায় কিছু হোমওয়ার্ক করুন এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। (এ বিষয়ে আমার আরেকটি পোস্ট পড়ে নিন: আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা থেকে বাঁচবেন কী করে?: https://tinyurl.com/atynzp3e)
১০. শরীয়ত সম্মতভাবে ব্যবসার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি দেশীয় আইন অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের অধিকার সুনিশ্চিত কিনা – এ বিষয়টিও দেখুন। কারণ দেশীয় আইনে বিনিয়োগকারীদের যদি কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠিত না থাকে, সে ক্ষেত্রে একজন প্রতারকের জন্য প্রতারণা করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কাজেই কোন ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তার আদৌ আইনি কোনো অবকাঠামো রয়েছে কি-না – এ বিষয়টি খেয়াল করুন।
–
ইউসুফ সুলতান
১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১