কওমী মাদরাসায় স্বতন্ত্রভাবে ‘অর্থনীতি ও মু’আমালাত বিভাগ’ খোলার প্রয়োজনীয়তা

শুরুর কথা,

এ কথাটি সকলের কাছেই স্পষ্ট যে, মানব জীবনের সকল অংশের ব্যাপারেই ইসলামের তা’লীম ও হেদায়াত নিহিত রয়েছে। সেটি হতে পারে ব্যক্তিগত জীবন, হতে পারে রাষ্ট্রীয় জীবন। এটি শুধু আকীদার অংশ নয়; বাস্তবতাও বটে। তবে তা আমরা কতটুকু উপলব্ধি করছি, বাস্তবায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছি-তা অবশ্য চিন্তার বিষয়।

আমাদের কওমী মাদরাসার পড়াশোনা শুধু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকেন্দ্রিক নয়; বরং তা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণীতেও প্রভাব বিস্তার করার সক্ষমতা রাখে। তন্মধ্যে অন্যতম হল ইসলামের অর্থনীতি। ইসলাম যেমন পূর্ণাঙ্গ, তার অর্থনীতি, মুআমালাত নীতিও সমৃদ্ধ, পূর্ণাঙ্গ। সর্বযুগে সমাধান ও প্রয়োগযোগ্য। অর্থনীতি বিষয়ে ইসলামের তা’লীমাত কেবল ব্যক্তিগতভাবে হালাল জীবন-যাপনের জন্য নয়। বরং একটি রাষ্ট্রকেও হালাল ও সঠিকভাবে পরিচালিত করার যোগ্যতা তার মাঝে নিহিত। প্রয়োজন সেই যোগ্যতা প্রমাণ করা, যুগের ভাষায় বলিষ্ঠ উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরা।

কওমী মাদরাসার অবদান

এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, যুগ যুগ ধরে নানা দেশে দারুল উলূম দেওবন্দ ধারার কওমী মাদরাসাসমূহ সমাজ ও রাষ্ট্রে নানামুখী অবদান রেখে যাচ্ছে। একটি সভ্য, সুনাগরিক গড়ে তুলতে কওমী মাদ্রাসার তুলনা নজিরবিহীন। শিক্ষা ও নৈতিকতার মাঝে এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি করে যাচ্ছে দেশের কওমী মাদরাসাসমূহ। দ্বীন ও ঈমান রক্ষার সূতিকাগার হিসাবে সুপরিচিত কওমী অঙ্গন। আমরা চাই দ্বীন, দেশ ও জাতির তরে  মাদরাসাসমূহের সেবার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হোক। ছড়িয়ে পড়ুক এর আবেদন ও অবদান সর্বক্ষেত্রে।

বর্তমান বিশ্ব

বর্তমান পুরো বিশ্ব যে নীতি ও বিশ্বাসের সামনে মাথা নত করছে, তা হল অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক বিশ্বাস। একটি রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছে অর্থনৈতিক নীতি ও তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি দেশের বাজেট তৈরি হয় দেশটির অর্থনীতির আলোকে। দেশের অর্থনীতিতে যদি সুদ স্বীকৃত হয়, তবে বাজেটেও সুদ থাকবে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সকল কার্যক্রমে সুদ সদর্পে অবস্থান করবে।

একটি দেশের অর্থনীতিতে যদি পুঁজিবাদ বিশ্বাসের স্থান করে নেয়, তবে দেশটির সকল স্তরে পুঁজিবাদের কুপ্রভাব প্রবল হয়ে উঠবে।

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও অর্থনীতি

আমরা কি জানি,আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অর্থনীতি কিভাবে পরিচালিত হয়? আমাদের প্রায় প্রতিটি বাজেটেই কর বহির্ভূত আয়ে সুদ থেকে প্রাপ্ত আয় থাকে শীর্ষে। আর ব্যয়ের খাতে সুদ বাবদ ব্যয় থাকে শীর্ষ চতুর্থে। প্রতি বছরই দেশের অর্থনীতিতে সুদ বাবদ ব্যয়ভার বেড়েই যাচ্ছে। আমার আপনার কর ও ভ্যাটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যায় এই সুদ বাবদ ব্যয়ে। রিবা বা সুদ এর কুফল নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সচেতন করছি, কিতাব পড়াচ্ছি। লম্বা আলোচনাও করছি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সেই আওয়াজ আমরা পৌঁছাতে পারছিনা। আমরা পারছিনা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও কৌশলী কর্মগ্রহণের মাধ্যমে চলমান অর্থনীতির লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে। ইসলামের অর্থব্যবস্থার আলোকে বিরাজমান অর্থব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে। এর নানা দুর্বলতা তুলে ধরতে। আমাদের অবহেলায় আমাদের দেশে আজ ইসলামী ইকতেসাদ বড় অবহেলার শিকার।

আফসোস,ইসলাম যে একটি সমৃদ্ধ ও ভারসাম্য অর্থব্যবস্থার কথা বলে,আমরা যারা প্রথাগত পড়াশুনা শেষে ‘ফারেগীন’ লকব ধারণ করি, অনেকে না নিজেরা তা জানি, আর না যুক্তির আলোকে সমাজের ভাষায় সমাজের মানুষের সামনে তা তুলে ধরার সক্ষমতা রাখি।

সুদ হারাম, শুধু এতটুকু বলাই কি যথেষ্ট?

রাষ্ট্রকে ‘সুদ হারাম, তা বর্জন করতে হবে’ শুধু এতটুকু বলা যথেষ্ট নয়। দেখাতে হবে এর টেকসই বিকল্প। বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনায় পেশ করতে হবে বিভিন্ন দেশ ও ইতিহাস হতে আহরিত গবেষণা ও কর্ম। কিভাবে জিরো পার্সেন্ট সুদেও একটি দেশের অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে, কিভাবে সরকারের বাজেট প্রণয়নে সুদকে হ্রাস করা যায়- এ ধরনের নানা প্রয়োগমুখী বিকল্প পেশ করতে হবে। পেশ করতে হবে নানা গবেষণা ও প্রমাণ-উদাহরণ।

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ৭০% নিয়ন্ত্রিত হয় সুদী ব্যবস্থার মাধ্যমে। দেশের বীমা সেক্টরের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয় সুদী পদ্ধতিতে। প্রতিটি সেক্টরে হাজার হাজার মুসলিম জনগণ নানা ভাবে সম্পৃক্ত।

ইসলামী ব্যাংকিং নামে যা আছে, সেখানেও শারিয়াহ-উন্নয়নের নানা সুযোগ থেকে গেছে। এভাবে তালিকা করতে গেলে তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। দেশের দুটি শেয়ার মার্কেটে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। বহু মানুষের জীবিকা এর সাথে জড়িত। সেখানে কতটুকু শারিয়াহ পরিপালিত হয়? আমি-আপনি হয়তো এসবে জড়িত নই; তবে হাজারও মানুষ সম্পৃক্ত। তাদের আয় রোজগারে যেন হালাল নিশ্চিত হয় এমন পন্থা নির্দেশ করা আমাদেরই কর্তব্য।

আধুনিক মুআমালাত ও শারিয়াহ প্রয়োগ: শূন্যতা ও সমাধান

কোডিভ-১৯ এর পর ব্যবসা-বাণিজ্যে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষ অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায় অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। জন্ম নিয়েছে ব্যবসার নানা আধুনিক প্রয়োগ। সব মিলিয়ে দিন দিন ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা রূপ ও চিত্র নতুন থেকে নতুন হচ্ছে। এসবের সাথে শারিয়াহকে প্রয়োগমুখী করার কাজ আমরা কতটুকু অগ্রসর করতে পারছি?

বলতে দ্বিধা নেই-উত্তরগুলো আমাদের কারো কাছেই সন্তোষজনক নয়। আমাদের ফারেগ ও ফাযেলগণ অধুনা বিশ্বের নানামুখী আর্থিক লেনদেনে শারিয়াহ-প্রয়োগ জানা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনকভাবে পিছিয়ে আছেন। ফিকহুল মুআমালাত-গবেষণায় আমাদেরকে তাকিয়ে থাকতে হয় বাহিরের আলিমগণের সমাধানের দিকে। তাদের সমাধান ও ইলম থেকে উপকৃত হতে তো বাধা নেই। তবে এর সাথে সাথে আমাদেরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার ও ফিকহী নানামুখী সমস্যার সমাধানের যোগ্যতা অর্জন করবার অব্যাহত সাধনায় নিরত থাকা জরুরী।

প্রতি বছর শত শত তালিবুল ইলম দারুল ইফতা থেকে ফারেগ হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে তাদের কজন আধুনিক মুআমালাত বোঝা  ও তাতে শারিয়াহ-প্রয়োগ করতে সঠিক অর্থে সক্ষম ?

আমাদের আকাবির স্বপ্ন দেখিয়েছেন-রাষ্ট্রকে, সমাজকে, দেশের সকল সেক্টরকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় নিয়ে আসতে। কিন্তু কার্যত আমরা ইসলামের অন্যতম দিক- মুআমালাত ও ইকতেসাদকে সেভাবে কাজের আওতাভুক্ত করতে পারছি না। এটি কোনওভাবেই কাম্য নয়।

আল্লামা শামসুল হক আফগানী রহ., আল্লামা হিফযুর রহমান সিওহারভী রহ., আল্লামা মানাযের আহসান গিলানী রহ.সহ প্রমুখ আকাবির আলিম এ অঙ্গনে অসামান্য অবদান তৈরি করে গিয়েছেন। আমরা কি আকাবিরের সেই অবদান ও রাহনুমায়ী দিন দিন বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি!!

শুধু হারাম হওয়ার ফতোয়া প্রদানই কি যথেষ্ট?

মুআমালাত, অর্থনীতি বিষয়ে এইটা হারাম, ঐটা হারাম- শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে টেকসই বিকল্প (যেখানে যেটা সম্ভব সেটা) ও বলতে হবে। সুদমুক্ত অর্থনীতি কিভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা হতে পারে-সে ধরনের বিভিন্ন গবেষণাও আমাদের থাকতে হবে। দূর থেকে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিং-এর শুধু সমালোচনা মানুষের ইনকাম হালাল করার জন্য যথেষ্ট নয়। এ খাতে ইতিবাচক অবদান তৈরির মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দরদী ভাষায় সংশোধনের টেকসই পথটুকু দেখাতে হবে।

হালালভাবে চলতে চায় এমন প্রতিষ্ঠানকে পথ দেখাবে কে?

বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এখন তাদের ব্যবসাকে হালাল পন্থায় পরিচালিত করার দিকে ঝুকছে। ব্যবসায় লস হবে, তবু হারাম খাবে না-ইসলামী ব্যাংকিং ছাড়াও এমন বহু ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নানা সময়ে আমাদের কাছে তারা তাদের সেই মনের ব্যাকুলতা তুলে ধরেন। হন্য হয়ে খোঁজেন একজন আলিমকে। যিনি কাদিম ফিকহের পাশাপাশি জাদীদ ফিকহুল মুআমালাত যুগের ভাষায় বুঝতে ও বোঝাতে সক্ষম হবেন। আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় সেই যোগ্যতাসম্পন্ন রিজাল তৈরি করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মুফতি তাকী উসমানী দা.বা. বহু আগেই বলেছেন-এখন আলিমদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এমন হওয়া চাই, যারা কর্পোরেট অঙ্গনে আর্থিক বিষয়ে শারিয়াহ পরামর্শ প্রদান ও বাস্তবায়নের যোগ্যতা রাখবেন।

মানুষের লোকমা হালাল হয়ে যাক-এই তড়প ও ব্যথা তো একজন আলিম ও দায়ীর অন্যতম পরিচয়।

স্বতন্ত্র বিভাগ কেন খোলা হয়?

দেশের অর্থনীতির নানা অঙ্গন-ইসলামের অর্থনীতি, ফিকহুল মুআমালাতের সাথে পরিচিত নয়। আমাদের মুআমালাতের পড়াশোনা অনেকাংশেই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখছে না। বরং তা মাদরাসার সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকছে । এর বাহিরে যারা নিজ থেকে মুআমালাতের কোনও মাসআলা জিজ্ঞাসা করে, আমাদের উত্তর তখন সেই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। খুব স্বল্প পরিসরে কিছু ওয়াজ ও বয়ানে অগ্রসর হয়ে নিজ থেকে হালাল-হারামের কথা উঠে আসে। কিন্তু আরও অগ্রগামী হয়ে সময় ও দেশের ভাষায় প্রচলিত জং-ধরা অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা,এর বিকল্প শক্তি ও সমাধান হিসাবে ইসলামের অর্থব্যবস্থাকে তুলে ধরা-এই কাজটি আমরা করতে পারছি কি?

মাদরাসাসমূহে এক সময় স্বতন্ত্র ফতোয়া বিভাগ ছিল না। এরপর সময়ের প্রয়োজনে তা করা হয়েছে। তেমনিভাবে আদব বিভাগ, রদ্দে কাদিয়ানী বিভাগ ইত্যাদি।

দ্বীন ও সমাজের হেফাযতে যদি আমরা রদ্দে কাদিয়ানী বিভাগ করতে পারি, তাহলে অর্থনীতিতে ইসলামের তা’লীমাত তুলে ধরতে, চলমান পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে, সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বতন্ত্র ইসলামী অর্থনীতি ও মুআমালাত বিভাগ খোলাও একান্ত প্রয়োজন। সময়ের এই প্রয়োজনকে কোনভাবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ না খুললে কী ক্ষতি হবে?

অর্থনীতি ও মুআমালাত বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ ও তাখাসসুস না খোলা হলে কিংবা খুলতে বিলম্ব  হলে, যেসব ক্ষতি হওয়ার বড় আশংকা হয় তাহলো-

-মানুষের কাছে ইসলাম অপূর্ণরূপে প্রকাশ পাবে। অর্থনীতিকে ইসলামের অংশ মনে করা হবে না।

-সুদ হারাম, গারার হারাম-এসব কথা তাদের কাছে একান্ত বাড়াবাড়ি মনে হবে।

-হালালের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু আমাদের অবহেলার কারণে মানুষ হালালের পথ খুঁজে পাবে না, ফলে হারামে লিপ্ত থাকবে।

-শুধু হারাম বা নাজায়েয ফতোয়া দিয়েই আমরা ক্ষান্ত হয়ে যাবো। মানুষের সমস্যা বোঝা ও সমাধানে ব্রতী হতে পারবো না।

-আমাদের নিজেদের আয়েও একসময় আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হারামের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। অন্তত শোবাহ-সন্দেহ তো প্রবেশ করবেই। কারণ, চারপাশ ভালো না রেখে নিজে ভালো থাকারও কোন সুযোগ নেই। দিন শেষে যে ব্যাংকিং আমরা করবো-সেটিও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

 ইসলামী অর্থনীতিবিদ-তৈরিতে মাদরাসা কতটুকু প্রস্তুত?

দ্বীন ও সমাজের প্রয়োজনে আমরা দাওরা ফারেগ আলিমকে এখন স্বতন্ত্র দাওয়াহ বিভাগে পড়ানোর মাধ্যমে ‘দায়ী’ হিসাবে তৈরি করছি। উলূমুল হাদীস বিভাগের মাধ্যমে হাদীসের উস্তায তৈরি করছি। আদব বিভাগ খোলার মাধ্যমে আদিব তৈরি করছি। কিন্তু এই মাদরাসাসমূহ হতে অর্থনীতি অঙ্গনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন অনুপাতে ইসলামী অর্থনীতিবিদ তৈরি করতে পারছি না কেন? এর উত্তর ও সমাধান আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী ইসলামী অর্থনীতির অগ্রযাত্রা

নানা জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক বিশ্বে ইসলামী অর্থনীতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, অন্য কোন অর্থব্যবস্থা সেভাবে অগ্রসর হচ্ছে না। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ইসলামী ফাইন্যান্সের এ্যাসেট আকার বেড়েই যাচ্ছে। ২০২৫ ইং সনে এর আকার ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে সম্ভাবনা দেখা হচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই ইসলামী অর্থনীতির দিকে এখন ঝুঁকছে। কারণ, এটিই বর্তমানে একমাত্র অর্থনীতি যা এ্যাসেট বেইসড ফাইন্যান্সের (সম্পদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা) কথা বলে। অপরদিকে প্রচলিত সুদী অর্থব্যবস্থা নিরেট ‍ঋণভিত্তিক অর্থায়নের কথা বলে। যা প্রথমটির তুলনায় অধিক টেকসই নয়। এ সত্য অস্বীকার করা অসম্ভব। তাই তো ২০০৮ এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় যখন সুদী অর্থনীতির ধারক প্রতিষ্ঠানসমূহ হুমকির মুখে পড়ে যায়, সেসময় ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়েছিল।

এই অগ্রসর ইসলামী অর্থনীতির সাথে আমাদের মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরকে পরিচিত করা একান্ত জরুরী। শুধু পরিচিত নয়;অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী অর্থনীতিতে দুকতুরা ডিগ্রি প্রাপ্তির সুবিধাসহ ইসলামী অর্থনীতিবিদ তৈরির পরিকল্পনা করতে হবে। যেনো চলমান অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে তারা ইসলামী অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন।

আমাদের সম্ভাবনা

কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষার্থীগণ যথেষ্ট মেধাবী ও পরিশ্রমী। সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাই হতে পারেন এক সময়ের দেশের ইসলামী অর্থনীতিবিদ। প্রয়োজন একজন সচেতন দায়িত্বশীলের সঠিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও রাহনুমায়ী।

বিভাগ পরিচালনার অবকাঠামোগত প্রস্তাবনা

অর্থনীতি ও মুআমালাতের উপর একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খুলতে হলে, প্রথমেই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এরপর একজন বিজ্ঞ উস্তাযের তত্ত্বাবধানে এ বিভাগের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। কাহতে রিজালের এই যামানায় প্রথমদিকে হয়ত এ বিষয়ে বিজ্ঞ উস্তায পাওয়া কঠিন হতে পারে। আল্লাহর উপর ভরসা করে শুরু করলে ধীরে ধীরে এ অভাব দূর হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। ২-৩ বছর মেয়াদী হবে এই বিভাগ। যারা অন্তত দুই বছর ইফতা পড়ে আসবেন, তারা সরাসরি দ্বিতীয় বছরে ভর্তির সুযোগ পাবেন। এছাড়া বাকিদের অন্তত দুই বছর পূর্ণ করতে হবে। এই দুই বছর হবে একাডেমিক দুই বছর । তৃতীয় বছর হবে গবেষণা, ফিল্ড ওয়ার্ক, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি প্রয়োগমুখী কাজ। আলহামদুলিল্লাহ, এর বিস্তারিত একাডেমিক সিলেবাস আমরা তৈরি করেছি। সেই সিলেবাস অনুযায়ী, ঢাকার বুকে মুরুব্বী আলিমগণের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে-‘মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী’। দেশের অন্যতম ফিকহুল মুআমালাত ও ইসলামী ফিন্যান্স চর্চাকারী প্রতিষ্ঠান-আইএফএ কনাসলটেন্সি এর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে।

শেষ কথা,

আইএফএ কনসালটেন্সি, দীর্ঘ দিন যাবৎ মানুষের মাঝে হালাল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী কাজ করে যাচ্ছে। এসব বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, আরও ব্যাপকভাবে চলমান অর্থব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামের অর্থনীতিকে তুলে ধরতে আমাদেরকে অর্থনীতিতে বিজ্ঞ এক দল আলেমে দ্বীন তৈরি করতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে বিষয়টির গভীরতা ও বাস্তবতা বোঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।

(আইএফএ কনসালটেন্সির পক্ষে মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম। উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দা.বা. (শাইখুল হাদীস, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, ঢাকা, প্রধান মুরুব্বী ও উপদেষ্টা, আইএফএ কনসালটেন্সি) এর আদেশ ও পরামর্শে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। তারিখ: ১লা শাওয়াল, ১৪৪৪হি.)

Share